ইমাম হযরত আবু হানিফা (রহঃ) এর জীবনী - Madhhab Hanafi
![]() |
| Madhhab Hanafi |
ইমাম হযরত আবু হানিফা (রহঃ) এর জীবনী
ইমাম আবু হানীফাঃ হযরত ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) কুফার অধিবাসী ছিলেন। তিনি আবেদ, জাহেদ, সংসার বিমুখ, খোদাপ্রেমিক এবং খোদাভীরু ছিলেন। স্বীয় সাধনালব্ধ ইলমের মাধ্যমে তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রত্যাশী ছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে মুবারকের বর্ণনার মাধ্যমে তাঁর বিস্ময়কর ইবাদাতের ধারা অবহিত হওয়া যায়। তিনি সৎ স্বভাবাপন্ন, শালীন রুচিসম্পন্ন এবং অত্যদ্ভূত ইবাদাতগুজার ব্যক্তি ছিলেন। অত্যধিক পরিমাণে নামায আদায় করতেন তিনি।
মহাত্মা হাম্মাদ বিন সুলাইমান বলেন, তিনি রাতভর (ইবাদাতের মধ্যে জাগ্রত থাকতেন। আর এক বর্ণনায় জানা যায়, তিনি অর্দ্ধ রাত জেগে নামায পড়তেন। একদা তিনি কোথাও যাওয়ার পথে লোকগণ তাঁর দিকে ইশারা করে বলাবলি করল যে, এ ব্যক্তি সারারাত জেগে নামায আদায় করে। এ কথা শোনার পর থেকে তিনি আর অর্ধরাত নয়, সত্যিই সারা রাত জেগে নামায আদায় করা শুরু করলেন এবং বললেন, আমি আল্লাহর দরবারে লজ্জাবোধ করছি এজন্য যে, আমি তাঁর যতটা ইবাদাতে রত নই, লোকগণ আমার সম্পর্কে ততটাই ধারণা করছে।
ইমাম সাহেবের সংসার বিমুখতা সংক্রান্ত পরিচয় লাভ করা যায় রবী বিন আছেমের একটি বর্ণনা থেকে। তিনি বলেন, আমি খলীফা ইয়াজিদ ইবনে আমরের নির্দেশক্রমে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-কে তার দরবারে নিয়ে গেলাম। খলীফা তাঁকে বাইতুল মালের প্রশাসক বা সর্বাধিনায়ক পদগ্রহণের জন্য অনুরোধ জানালেন, কিন্তু ইমাম সাহেব খলীফার সম্মুখে তখনই তা সরাসরি ভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন। ফলে ক্ষুণ্ণ খলীফা তাকে বিশটি বেত্রাঘাতের শাস্তির ভয় দেখালেন। কিন্তু ইমাম সাহেব ভীত হলেন না। তিনি অম্লান বদনে সে শাস্তি গ্রহণ করলেন, তবু এই রাজকীয় উচ্চপদের প্রতি এতটুকু লালায়িত হলেন না।
হাকাম ইবনে হেশাম ছকফী বলেন যে, আমি সিরিয়ায় মানুষকে বলাবলি করতে শুনলাম যে, তিনি মানুষের মধ্যে বিশ্বস্ততায় শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন, এ কারণে খলীফা তাঁকে সরকারী খাজাঞ্চিখানার খাজাঞ্চি পদে নিয়োগ করতে চাইলে তিনি তা' অবহেলার সাথে প্রত্যাখ্যান করলেন। খলীফা তাঁকে শাস্তির ভয় দেখালেন; কিন্তু তিনি তাতে এতটুকু মাত্র বিচলিত না হয়ে স্বমতে অটল থাকলেন এবং খলীফার কঠোর শাস্তি হেলায় বরণ করলেন। মোটকথা তিনি আল্লাহর শাস্তির তুলনায় খলীফার শাস্তিকে নগণ্য মনে করেছিলেন।
একবার ইবনে মুবারকের সামনে ইমাম আবু হানীফার (রহঃ) বিষয় উত্থাপিত হলে তিনি বললেন, তোমরা তাঁর কথা কি বলছ, যার সামনে পার্থিব সুখ-সম্পদ হাজির হয়েছে, আর তিনি তা' অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। মুহাম্মদ ইবনে শুজা বলেন, ইমাম আবু হানীফার (রহঃ) এক শিষ্যের কাছে শুনেছি, একবার কেউ তাঁকে বলল, জনাব! আমীরুল মু'মিনীন আবু জাফর মনছুর আপনাকে দশ হাজার দেরহাম দিতে নির্দেশ করেছেন। ইমাম সাহেব শুনে কোন কথা বললেন না। তারপর যে দিন এই অর্থ তাঁর কাছে পৌছার কথা ছিল, সেদিন তিনি ফজরের নামায পড়ে কাউকে কিছুই না বলে চাদরাবৃত হয়ে শুয়ে পড়লেন। অতঃপর হাসান ইবনে কাহতাবার দূত উক্ত অর্থ নিয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হয়ে তাঁকে ঐ অবস্থায় দেখে অবাক হলেন। উপস্থিত এক ব্যক্তি দূতকে বলল যে, তিনি আজ ভোর থেকে কারও সাথে কোন কথা বলছেন না। এমনিও তাঁর কম কথা বলা অভ্যাস। আপনি অর্থের থলেটি ঘরে রেখে যান। দূত অর্থের থলেটি ঘরে রেখে বিদেয় হয়ে গেল।
এর দীর্ঘ দিন পরে ইমাম সাহেব তাঁর বিষয়-সম্পদ ওয়ারিসদের মাঝে অসিয়ত করাকালে স্বীয় পুত্রকে বললেন, আমার মৃত্যুর কাফন-দাফন শেষ করে এ অর্থের থলেটি নিয়ে হামান ইবনে কাহতাবার কাছে পৌঁছে দিয়ে বলবে, আপনি আমার পিতা আবু হানীফার কাছে যে অর্থ আমানত রেখেছিলেন তা' এই গ্রহণ করুন। অসিয়ত অনুযায়ী পুত্র অর্থের থলেটি হাসান ইবনে কাহতাবার কাছে পৌছে দিলে তিনি অবাক বিস্ময়ে এ মন্তব্য করলেন, আপনার পিতার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষিত হোক। সত্যি তিনি দ্বীন ধর্মের প্রতি অত্যন্ত সজাগ ছিলেন।
কথিত আছে যে, একবার রাজ্যের প্রধান বিচারকের পদ গ্রহণ করার জন্য খলীফার তরফ থেকে আহ্বান এলে তিনি খলীফার দরবারে উপস্থিত হয়ে বললেন, আমীরুল মু'মিনীন! আমি এ পদের জন্য যোগ্য নই । খলীফা বললেন, আপনি নিঃসন্দেহে এ পদের জন্য যোগ্য ব্যক্তি। ইমাম সাহেব বললেন, আপনার ধারণায় হতে পারি, কিন্তু আমি কথায় সত্যবাদী হলে, নিশ্চয় অযোগ্য। আর যদি আমি মিথ্যেবাদী হয়ে থাকি, তবে এক মিথ্যেবাদী ব্যক্তি এ গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য কোনক্রমেই যোগ্য হতে পারে না (খলীফা এ কথার কোন জবাব খুঁজে পেলেন না।)
ইমাম আবু হানীফার (রহঃ) আখেরাতের ইলম দ্বীনী বিষয়ক প্রজ্ঞা, মা'রেফাতে ইলাহীর গভীরতা এবং খোদাভীরুতার আধিক্য তাঁর বৈরাগ্য এবং সংসার বিমুখতাই প্রমাণ করে |
ইবনে জুরাইজ (রহঃ) বলেন যে, আমি বেশ করে অবহিত আছি, নোমান ইবনে ছাবেত কুফী (আবু হানীফা রহঃ) আল্লাহকে অত্যধিক ভয় করেন। শুরাইক নখয়ী (রহঃ) বলেন, ইমাম আবু হানীফা নীরব থাকতেন, চিন্তা-ভাবনা তথা ধ্যান-ধারণায় ও গবেষণার মধ্যে সময় কাটাতেন, মানুষের সাথে কথা খুবই কম বলতেন। ধর্মীয় জটিল বিষয়াদি, মাসলা মাসায়েল এবং ইলমে বাতেনের তত্ত্বোদঘাটনে সদা-সর্বদা ব্যাপৃত থাকতেন। কেননা এভাবে কথা কম বলা ও চিন্তায় থাকা নিগূঢ় এবং গভীর জ্ঞানার্জনের একমাত্র উপায়।
(এহ্ইয়াউ উলূমিদ্দীন- ১ম খন্ড)
