ইমাম হযরত শাফেয়ী (রহঃ) - এর জীবনী | ৪ ইমামের সংক্ষিপ্ত জীবনী - পর্ব ২

 


ইমাম হযরত শাফেয়ী (রহঃ) - এর জীবনী | ৪ ইমামের সংক্ষিপ্ত জীবনী - পর্ব ২, ইমাম শাফেয়ীর উক্তি, ইমাম শাফেয়ী বই, ইমাম শাফেয়ীর জীবনী, ৪ ইমামের জীবনী
হযরত ইমাম শাফেয়ী রহঃ





ইমাম শাফেয়ী রহঃ এর জীবনী | ৪ ইমামের জীবনী


ইমাম শাফেয়ী (রহঃ): ইমাম শাফেয়ীর (রহঃ) ইবাদাতের পরিচয় নিম্নোক্ত বর্ণনা থেকেই লাভ করা যায়। তিনি রাত্রকে তিন ভাগে ভাগ করে একভাগ ইলমের জন্য, ২য় ভাগ নামাযের জন্য এবং ৩য় ভাগ নিদ্রার জন্য নির্দিষ্ট করে নিয়েছিলেন। রবী বলেন যে, ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) মাহে রমজানে ষাটবার কুরআন খতম করতেন এবং তা তাঁর সে মাসের নামাযের মধ্যেই সম্পাদিত হত। বুয়াইতী ছিলেন তাঁর শিষ্যদের অন্যতম, তিনি রমজান মাসের প্রতিদিন একবার করে কুরআন খতম করতেন। হাসান ইবনে কারাবেছী (রহঃ) বলেন, আমি ইমাম শাফেয়ীর (রহঃ) সহিত অনেক রাত্রি কাটিয়েছি। তিনি রাত্রিগুলোর এক-তৃতীয়াংশ নামাযে অতিবাহিত করতেন! প্রতি রাকাতে তিনি পঞ্চাশ আয়াত কিরাত পড়তেন, কদাচিৎ উর্দ্ধে একশ আয়াত পড়তেন। এর মধ্যে রহমতের আয়াত পাঠকালে তিনি নিজের জন্য এবং সমস্ত মু'মিন মুসলমানের জন্য রহমত লাভের প্রার্থনা করতেন এবং যখন তিনি আযাবের আয়াত পাঠ করতেন, তখন আযাব থেকে নিজের ও সমস্ত মুসলমানের পরিত্রাণের জন্য আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানাতেন। এভাবে আশা ও নিরাশা উভয়ই তাঁর অন্তর মধ্যে বিরাজ করত। প্রতি রাকাতে পঞ্চাশ আয়াত কিরাত পড়ার মধ্যে কুরআনের কোন গুপ্ত রহস্যে তাঁর গভীর অভিজ্ঞতারই প্রমাণ বহন করে। তিনি নিজেই বলেছিলেন যে, ষোল বছর ধরে আমি কোন দিন তৃপ্তি সহকারে আহার করি নি। কেননা এভাবে তৃপ্তি সহকারে উদরপূর্তি আহার দেহকে ভারী করে ফেলে, দিলকে কঠিন এবং জ্ঞানের সূক্ষ্মতাকে হরণ করে। এতে নিদ্রাবৃদ্ধিজনিত কারণে ইবাদাত হ্রাস পায়, ইবাদাতে আলস্য বৃদ্ধি পায়। উদরপূর্তি আহার সম্পর্কিত তাঁর এ উক্তি সত্যিই তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতার এক জ্বলন্ত প্রমাণ। ইবাদাতের প্রতি তিনি কত বেশী আকৃষ্ট ছিলেন, তা' তাঁর খাদ্য সম্পর্কিত এ কৃচ্ছ্রতার মাধ্যমে পরিষ্কার ভাবে অনুধাবন করা যায়।

 ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) বলেন, আমি আল্লাহর নামে কখনও মিথ্যা শপথ তো দূরের কথা, সত্য শপথও করি নি। তাঁর এ উক্তির দ্বারা আল্লাহর মর্যাদা ও সম্মান রক্ষার প্রতি তাঁর সতর্কতা ও ঐকান্তিকতার প্রাবাল্য এবং একনিষ্ঠতা প্রকট হয়ে উঠেছে। একবার এক ব্যক্তি তাঁর কাছে একটি মাসলার বিষয় জিজ্ঞেস করলে তিনি বেশ কিছু সময় পর্যন্ত চুপ করে রইলেন। লোকটি বলল, আল্লাহ আপনাকে রহম করুন, আপনি কিছু বলছেন না কেন? তিনি বললেন, কল্যাণ কি চুপ থাকার ভিতর, না কি জবাব দেয়ার ভিতর, তা' না জেনে নিয়ে আমি জবাব দিচ্ছি না। এখন চিন্তা করুন, কোন কিছু উক্তি করার মধ্যে তিনি কত বেশী সাবধানতা অবলম্বন করতেন। অথচ দেখা যায়, সাধারণ ফোকাহাদের অন্যান্য অঙ্গ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও রসনা ছিল বল্গাহীন। ইমাম সাহেবের উক্ত মন্তব্য দ্বারা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, তিনি কথা বলা ও চুপ থাকার মধ্যেও ছওয়াবের প্রত্যাশী ছিলেন।


আহমদ ইবনে ইয়াহইয়া (রহঃ) বলেন, একদা ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) বাজারের মোমবাতীর দোকান থেকে বের হয়ে চললেন। আমরাও তাঁর পিছনে পিছনে চলতে লাগলাম। পথে দেখা গেল, এক ব্যক্তি জনৈক আলিমের সাথে ঝগড়া করছে এবং তাঁর প্রতি অশ্রাব্য কটূক্তি প্রয়োগ করছে। ইমাম সাহেব আমাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা কানকে অশ্রাব্য উক্তি শোনা থেকে বাঁচিয়ে রাখ, যে ভাবে রসনাকে কটূক্তি করা থেকে রক্ষা করে থাক। কেননা শ্রোতাও বক্তার অশ্লীল বাক্যের শরীকদার হয়ে যায়। অজ্ঞ ও মূর্খ লোকেরা তাদের মগজের নিকৃষ্ট বস্তু তোমাদের মাথার ভিতরও ঢুকিয়ে দিতে চায় যে, তার সে অজ্ঞতাসুলভ বাক্য তার দিকেই ফিরিয়ে দেয়া হয় অর্থাৎ সে দিকে কান দেয়া না হয়, তবে যে সে কথা শোনল না, তাকে ভাগ্যবান বলতে হবে। পক্ষান্তরে বক্তা কিন্তু দুর্ভাগ্যবান।


ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) বলেন, তোমাকে যে ইলম দান করা হয়েছে, তুমি পাপাচার-অনাচার দ্বারা তার নূর মলিন করো না। তাহলে কিন্তু সব আলিম যেদিন নিজ নিজ ইলমের আলোকে পথ চলবে, সেদিন তুমি অন্ধকারের ভিতর হাবুডুবু খেতে থাকবে। নিম্নোক্ত বর্ণনা থেকে ইমাম শাফেয়ীর (রহঃ) সংসার বিমুখতার প্রকার অনুমান করা যাবে।


 তিনি বলেন, যে ব্যক্তি দাবী করে যে, আল্লাহর মহব্বত ও দুনিয়ার আকর্ষণ তার অন্তরে একই সাথে আছে, সে মিথ্যেবাদী।


 হুমায়দী (রহঃ) বলেন, ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) একবার এক শাসনকর্তার সাথে ইয়েমেনে যান এবং সেখান থেকে তিনি দশ হাজার দেরহাম নিয়ে মক্কা প্রত্যাবর্তন করেন। মক্কার শহরতলীতে তাঁর থাকার জন্য তাঁবু গাড়া হল, লোকজন তাঁর সাথে সাক্ষাত করতে আসতে লাগল। তিনি তাঁর অর্থগুলি সব বিলিয়ে দিয়ে খালি হাত না হওয়া পর্যন্ত তথায়ই থেকে গেলেন। একদা তিনি গোসলখানা থেকে বের হয়ে গোসলখানার জিম্মাদারকে অজস্র অর্থ দিয়ে দিলেন। আর একদিন তাঁর হাত থেকে লাঠিখানা পড়ে গেল। এক ব্যক্তি তা' তাকে তুলে দিলে তিনি এর বিনিময়ে তাকে পঞ্চাশটি স্বর্ণ মুদ্রা দান করলেন। মূলতঃ তাঁর বদান্যতা ছিল ধারণাতীত। সংসারবিমুখতা বা বৈরাগ্যের মূলই হল বদান্যতা। কেননা যে ব্যক্তি পার্থিব সম্পদ ভালবাসে, সে তা' নিজের কাছেই ধরে রাখতে চায়। কিন্তু যে পার্থিব সম্পদকে তুচ্ছ মনে করে, সংসারের প্রতি যার আসক্তি থাকে না, বদান্যতা ও দানশীলতার দ্বারা সে সম্পদমুক্ত হবে, এ তার সহজাত স্বভাব বৈকি! সংসারবিমুখতা ও বৈরাগ্যই হল যুহদের অর্থ বা বাস্তব রূপ। খোদাভীতি এবং আখেরাতের ব্যাপারে নিজেকে লিপ্ত রাখার ব্যাপারে ইমাম শাফেয়ীর (রহঃ) অবস্থাগুলো নিম্নোক্ত বর্ণনা থেকে উপলব্ধি করা যায়। 

একদা সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা ইমাম শাফেয়ীর (রহঃ) সামনে অন্তরের কোমলতা সম্পর্কিত একটি হাদীস বর্ণনা করলে তিনি বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। উপস্থিত লোকগণ সুফিয়ানকে বলল যে, তিনি হয়ত প্রাণত্যাগ করেছেন। সুফিয়ান বললেন, তাহলে যে যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ লোক বিদেয় হয়ে গেলেন। আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ বলেন, একদা আমি ও ওমর ইবনে বানানা আবেদ এবং সংসার বিরাগীদের সম্পর্কে আলাপালোচনা করতেছিলাম। ওমর বললেন যে, আমি মুহাম্মদ ইবনে ইদ্রীস শাফেয়ী (রহঃ) অপেক্ষা বেশী খোদাভীরু মিষ্টভাষী কাউকে দেখি নি। একবার আমি, ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) এবং হারেছ ইবনে লবীদ ছাফা পাহাড়ের দিকে গমন করলাম। হারেছ ছালেহ মুরারীর শিষ্য ছিলেন। তিনি তার মিষ্টি স্বরে তিলাওয়াত শুরু করলেনঃ


“হাযা ইয়াওমু ল্লাইয়ানত্বিক্বনা অলা ইয়ু’যানু লাহুম ফাইয়াতাযিরূন।"

 এ সময় দেখতে পেলাম, ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) আয়াত শুনে বিবর্ণ হয়ে গেলেন। তাঁর দে  সময় দেখতে পেলাম, ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) আয়াত শুনে বিবর্ণ হয়ে গেলেন। হ রোমাঞ্চিত হয়ে গেল ও তিনি কিছুক্ষণ ছটফট করে অচেতন হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পরে হুঁশ ফিরে এলে তিনি বললেন, হে মাবুদ! আমি আপনার দরবারে মিথ্যেবাদীদের স্থান এবং উদাসীনদের অপরাধ থেকে পানাহ চাচ্ছি। হে মাবুদ! আরেফদের অন্তর আপনার নিকটই আমানত এবং ভক্তদের গ্রীবা আপনারই বাধ্যগত। হে মাবুদ! আপনার কৃপাভাণ্ডার থেকেই আমাকে দান করুন এবং আপনার রহমতের পর্দায় আমাকে আবৃত করুন। আর আপনার স্বীয় সত্তানুরূপ কৃপা দ্বারা আমার ত্রুটি-বিচ্যুতি মোচন করে দিন। আবদুল্লাহ বলেন, এরপর আমরা সকলে সেখান থেকে উঠে বিদেয় হলাম। অতঃপর যখন আমি বাগদাদ পৌঁছলাম, ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) ইরাকে ছিলেন। একদা আমি নদীর কিনারে নামায আদায়ের জন্য অজু করতেছিলাম। তখন এক ব্যক্তি আমার নিকট দিয়ে যেতে যেতে বললেন, যুবক। সুন্দর রূপে অজু কর। তাহলে দুনিয়া ও আখেরাতে তুমি আল্লাহর তরফ হতে সুন্দর ব্যবহার লাভ করবে। আমি পেছনের দিকে ফিরে তাকালাম, দেখলাম, এক বুযর্গ ব্যক্তির পেছনে বহু লোক দল বেঁধে চলেছে। আমার অজু করা শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমিও ছুটে গিয়ে তাদের সাথে মিশলাম। একটু পরেই বুযর্গ ব্যক্তি আমার দিকে ফিরে বললেন, তোমার কিছু দরকার আছে কি? আমি বললাম, জি হ্যাঁ। আল্লাহ আপনাকে যা শিখিয়েছেন, তা থেকে আমাকেও কিছু শিখিয়ে দিন। তিনি বললেন, জেনে রাখ, যে আল্লাহকে সত্যিকার ভাবে বিশ্বাস করে, সে পরিত্রাণ পেয়ে যায়, যে অন্তরে দ্বীনের ভয় রাখে, যে ধ্বংসের কবল থেকে দূরে থাকে সে দুনিয়াতে বৈরাগ্য অবলম্বন করে, আখেরাতে আল্লাহ্ প্রদত্ত ছওয়াবরাশি দেখে তার নেত্র যুগল শীতল হবে। তারপর তিনি বললেন, আরও কিছু শুনতে চাও? আমি বললাম, জি হ্যাঁ।


তিনি বললেন, যার মধ্যে তিনটি গুণ পাওয়া যাবে, সে তার ঈমান পাকা-পোক্ত করে নিতে পারবে। প্রথম হলঃ অপরকে সৎকাজের নির্দেশ দেবে ও তার আগে নিজে অনুরূপ আমল করবে। দ্বিতীয় হলঃ অপরকে মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে ও তার আগে নিজে তা থেকে বিরত থাকবে। তৃতীয় হলঃ সর্বকর্মে আল্লাহর নির্ধারিত সীমার প্রতি লক্ষ্য রেখে চলবে, তা অতিক্রম করবে না। তারপর তিনি বললেন, আরও কিছু শুনবে? আমি বললাম, জি হ্যাঁ।


তিনি বললেন, দুনিয়ায় বৈরাগ্য অবলম্বন তথা পার্থিব মোহ বর্জন করে চলবে এবং আখেরাতের প্রতি উৎসাহী ও আগ্রহী থাকবে। সব কিছুর মূলে আল্লাহকে জানবে, ফলে তুমি নাজাত প্রাপ্তদের শামিল হবে। এ পর্যন্ত বলে তিনি শেষ করলেন এবং চলে গেলেন। তখন আমি লোকদের নিকট তাঁর পরিচয় জিজ্ঞেস করে জানতে পেলাম, ইনি মহাত্মা ইমাম শাফেয়ী (রহঃ)। উল্লিখিত বিবরণটির মাধ্যমে তাঁর কুরআনের আয়াত শুনে অচৈতন্য হওয়া ও আবদুল্লাহকে উপরোক্ত উপদেশগুলো দেয়ার ভেতর থেকে পরিষ্কার রূপে প্রমাণিত হয় যে, তিনি কোন স্তরের সংসার বিমুখ এবং খোদাভীরু ব্যক্তি ছিলেন। আল্লাহর মা'রেফাত ব্যতিরেকে এই পর্যায়ের সংসার বিমুখতা ও খোদাভীতি কিছুতেই অর্জন করা যায় না। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ এরশাদ করেছেনঃ


ইন্নামা ইয়াখশাল্লাহা মিন ইবাদিহিল উলামায়ু”


অর্থাৎ বান্দাদের মধ্যে আল্লাহ্ তায়ালাকে তারাই ভয় করে, যারা আলিম অর্থাৎ দ্বীনের জ্ঞান রাখে। (প্রিয় পাঠক-পাঠিকা!) ইমাম শাফেরীর (রহঃ) এইরূপ খোদাভীতি ও সংসারে অনাসক্তি ফিকাহ শাস্ত্রের জেহার লেয়ান, বায়ে সালাম, ইজারা প্রভৃতি বিষয় থেকে কিছুতেই অর্জিত হয় নি। হয়েছে কুরআন ও হাদীসের আখেরাত বিষয়ক জ্ঞানধারা থেকে। কেননা পূর্বযুগীয় ও হাল যমানার হিকমত তথা দর্শনে কুরআন ও হাদীস পরিপূর্ণ। ইমাম শাফেয়ীর (রহঃ) দর্শনভিত্তিক আলাপালোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠত যে, তিনি আধ্যাত্মিক রহস্য ও আখেরাত সম্পর্কিত বিষয়াবলীতে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। একবার তিনি রিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে নির্দ্বিধায় জবাব দিলেন, রিয়া এক ভীষণ ফেতনাহ। অন্তরে বৈষয়িক লিপ্সা ও আকাঙ্খা এর দ্বারাই সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ স্বভাবতঃ নফসের ভাবেদার হিসেবে আলিমগণ এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। ফলে তাদের আমলগুলো সব বরবাদ হয়ে যেতেছে। তিনি বলেছেন, যখন তুমি নেক আমল লিপ্ত হয়ে আত্মম্ভরিতার শিকার হয়েছ মনে কর, তখন মনে এ ভাবনাকে স্থান দান কর যে, কার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে তুমি এ আমল করছ, তুমি কি ছওয়াবের আগ্রহী ও আযাবের ভয়ে ভীত নও? আরও ভেবে দেখ, তুমি কার নিরাপত্তার প্রত্যাশী আর কোন বিপদের কবল থেকে আশ্রয়হীন। এ বিষয়গুলোর যে কোন একটি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলেই তোমার নিকট নগণ্য বলে মনে হবে এবং এভাবে তুমি আত্মাভিমান থেকে মুক্ত হতে পারবে। ইমাম সাহেবের এ উক্তির মধ্যে রিয়ার স্বরূপ ও প্রতিকার সম্পর্কিত ব্যবস্থাপনার নির্দেশ রয়েছে। বস্তুতঃ রিয়া অন্তরের ক্ষতিকর বিষয়গুলোর অন্যতম বস্তু।


ইমাম সাহেব বলেন, যে ব্যক্তি তার নফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখে না, তার ইলম কোন উপকারে আসে না। যে ব্যক্তি ইলম দ্বারা আল্লাহর আনুগত্য উদ্দেশ্য মনে করে, সে ইলমের মাহাত্ম্য বুঝে। প্রত্যেক ব্যক্তিরই শত্রু ও মিত্র আছে। অতএব তুমি (নিরাপত্তার প্রত্যাশী হলে) তাদের সাথে থাক, যারা আল্লাহর অনুগত। বর্ণিত রয়েছে যে, আব্দুল কাদীর ইবনে আবদুল আযীয একজন নেককার এবং খোদাভীরু ব্যক্তি ছিলেন। ইমাম শাফেয়ীকে তিনি ধর্মভীরুতা এবং খোদাভীতি সম্পর্কে বিভিন্ন রকম প্রশ্ন করতেন। ইমাম শাফেয়ীর তাঁর কাছে বেশ যাতায়াত ছিল। একদিন আব্দুল কাদীর ইমাম শায়েফীকে জিজ্ঞেস করলেন, ছবর (ধৈর্য্যা), ইমতিহান (পরীক্ষা) এবং তামকীন (প্রতিষ্ঠা) এগুলোর মধ্যে উত্তম কোনটি? তিনি জবাবে বললেন, তামকীন হলো নবী-রাসূলদের মর্যাদা। এটা পরীক্ষার দ্বারা অর্জিত হয়ে থাকে। সুতরাং পরীক্ষার দ্বারা ছবর আসে এবং ছবর দ্বারা তামকীন অর্জিত হয়। লক্ষ্যণীয় যে, আল্লাহ্ তায়ালা সর্বপ্রথম হযরত ইব্রাহীমের (আঃ) পরীক্ষা গ্রহণ করেছেন। তারপর দৈর্যের মাধ্যমে তিনি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। একইভাবে হযরত মূসা (আঃ) ও হযরত আইয়ুব (আঃ)-এর প্রথম পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়েছে। তারপর তাঁরা প্রতিষ্ঠা লাভে সক্ষম হয়েছেন। অনুরূপভাবে হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর ক্ষেত্রেও প্রথমে পরীক্ষা, তারপর ধৈর্য, তারপর তাঁকে প্রতিষ্ঠা ও রাজত্ব দান করা হয়েছে। সুতরাং বুঝা গেল, তামকীন অর্থাৎ প্রতিষ্ঠাই হল সর্বশ্রেষ্ঠ স্তর। আল্লাহ্ বলেন, 


“অকাযালিকা মাক্কান্না লিইউসুফা ফিল আরদ্বি" 


অর্থাৎ এমনিভাবে আমি ইউসুফকে মিসরে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছি।


হযরত আইয়ুব (আঃ) সম্পর্কে ভীষণ পরীক্ষা ও প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছেঃ


"অ আতাইনাহু আহলাহু অ মিছলাহুম মাআহুম রাহমাতাম্ মিন ইনদিনা অ যিকরা লিল আ'বিদীন"


অর্থাৎ আমি তাঁকে তাঁর পত্নী এবং তৎসহ আরও লোকজন দান করেছি। এ হল আমার তরফ থেকে পরম করুণা এবং ইবাদাতকারীদের জন্যে পরম শিক্ষা। ইমাম শাফেয়ীর এই জবাব দ্বারা অনুধাবন করা যায় যে, কুরআনে পাকের গভীর রহস্যে তাঁর প্রগাঢ় প্রজ্ঞা ছিল এবং সালেক তথা আল্লাহর পথের পথিকদের মর্তবা ও বৈশিষ্ট্যের স্তর সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট অভিজ্ঞ ছিলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ বিষয়গুলো ইলমে আখেরাতের শামিল। ইমাম শাফেয়ীকে একবার জিজ্ঞেস করা হল, মানুষ আলিম কখন হয়? তিনি জবাব দিলেন, যখন সে তার অর্জিত জ্ঞানে ব্যুৎপত্তি লাভ করে অন্য জ্ঞান অন্বেষণে ধাবিত হয় এবং যা অর্জিত হয় নি তৎসম্পর্কে চিন্তায় মগ্ন হয়, তখন সে আলিম হয়। জালিনুসকে কেউ জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি যে, একই রোগের জন্য এতগুলো অনুপানসহ ওষুধের তালিকা লিখলেন এর কারণ কি? জালিনুস বললেন, ওষুধ একই কিন্তু তার তীব্র প্রভাব কমাবার জন্য বিভিন্ন অনুপান দেয়া হয়। যেহেতু একক ওষুধ মারাত্মক হতে পারে। ইমাম সাহেবের এ ধরনের বিভিন্ন উক্তির দ্বারা তাঁর ইলমে মারেফাতের প্রজ্ঞা আন্দাজ করা যায়।


ইমাম শাফেয়ী ইলমে ফিকাহ ও ফিকাহ শাস্ত্রের তর্ক-বিতর্ক দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন কামনা করতেন। নিম্নোক্ত বর্ণনাগুলো তাই প্রমাণ করছে। 


ইমাম সাহেব বলেন, আমার ইচ্ছে মানুষ  এই শাস্ত্র দ্বারা ফায়েদাহ হাছিল করুক এবং এর কৃতিত্ব আমার দিকে সম্পৃক্ত না হোক। তাঁর একথা দ্বারা বুঝা গেল, ইলমের অপকার এবং ইলম দ্বারা খ্যাতি লাভে অহিত সম্পর্কে তিনি যারপর নেই সচেতন ছিলেন। তিনি এক্ষেত্রে ঐকান্তিকভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করতেন এবং সুখ্যাতি লাভের মোহমুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, আমি কস্মিনকালে কারও ভ্রান্তি প্রকাশ করার জন্য কারও সাথে তর্ক-বিতর্ক করি নি। কারও সাথে আলাপ করার কালে আমার এ উদ্দেশ্য থাকত যে, সে সততা ও সাহায্যপ্রাপ্ত হোক এবং তার প্রতি আল্লাহ্ তায়ালার কৃপা, হেফাজত এবং সমর্থন বহাল থাকুক। কারও সাথে কথা বলার সময় আমি এ বিষয়টির গুরুত্ব দেইনি যে, সত্য তার মুখ থেকে অথবা আমার মুখ থেকে বের হোক। আমার অভ্যাস এই যে, প্রকৃত সত্য কারো সামনে তুলে ধরার পর যদি সে তা গ্রহণ করে, তবে আমি তার ভক্ত হয়ে যাই। তার সাথে আমার পরম অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি হয়। পক্ষান্তরে প্রকৃত সত্য নিয়ে যদি কোন ব্যক্তি জোর করে আমার যুক্তি খণ্ডনে প্রয়াসী হয় তাহলে সে আমার নিকট অত্যন্ত হেয়রূপে প্রতিপন্ন হয় বরং আমি তার সাথে উঠা-বসা বর্জন করে দেই। তাঁর নিজের এ উক্তির দ্বারাই প্রতীয়মান হল যে, প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনে তাঁর একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টিই লক্ষ্য ছিল। এজন্যেই আবু ছওর বলেন, ইমাম শাফেয়ীর মত লোক আমি কোন দিন দেখি নি, অন্য কেউও দেখেছে বলে আমার জানা নেই।


ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, তিনি চল্লিশ বছর পর্যন্ত যত নামায পড়েছেন সব নামাযেই ইমাম শাফেয়ীর (রহঃ) জন্য দোয়া করেছেন। এ বর্ণনায় লক্ষ্যণীয় হল, দোয়াকারীর নিষ্ঠা এবং যার জন্য দোয়া করা হয় তার মর্তবা কত বেশী ছিল। আর এর সাথে এ যুগের আলিমদের অবস্থার দিকে তাকালে দেখা যাবে, পরস্পরের প্রতি হিংসা, বিদ্বেষ ও ঈর্ষায় তাদের অন্তর পরিপূর্ণ। মুখে তারা দাবী করে, পূর্বযুগীয় মনীষীদেরই অনুসরণ করে চলছে, কিন্তু আসলে মোটেই তা ঠিক নয়। ইমাম আহমদকে মুনাজাতে ইমাম শাফেয়ীর জন্য এত বেশী দোয়া করতে দেখে একদিন তাঁর পুত্র তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, কে ছিলেন ইমাম শাফেয়ী যার জন্য আপনি এত বেশী দোয়া করেন? তিনি জবাবে বললেন, পুত্র!  ইমাম শাফেয়ী এ জগতে সূর্যস্বরূপ ছিলেন। মানুষের জন্য ছিলেন তিনি সুস্বাস্থ সদৃশ। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! বলুনত এবার কে সেই ইমাম শাফেয়ীর অনুসরণ করে চলছে?


ইমাম আহমদ এরূপ বলতেন, যে কেউ দোয়াত স্পর্শ করে, সে ইমাম শাফেয়ীর কাছে মুখাপেক্ষী । ইহাহইয়া ইবনে সাঈদ বলেন, আমি চল্লিশ বছর ধরে এমন কোন নামায পড়িনি। যে নামাযে ইমাম শাফেয়ীর জন্য দোয়া করি নি। কারণ আল্লাহ্ তাঁকে ইলম দিয়েছেন আর তিনি তার দ্বারা দুনিয়ার মানুষকে সুপথ দেখিয়েছেন। মোটকথা ইমাম শাফেয়ীর গুণ ও সততার অভাব ছিল না, আর কত বর্ণনা করব, সংক্ষেপে কিছু কথা বলে এখানেই শেষ করছি।

👇

হযরত ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)

এহ্ইয়াউ উলূমিদ্দীন(১ম খন্ড)

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url