হযরত দাঊদ নবী (আঃ) - এর খোদা ভীতির অপূর্ব কাহিনী
হযরত দাউদ আঃ এর ঘটনা
![]() |
| নবীদের ঘটনা |
হযরত দাউদ নবী (আঃ) - এর খোদা ভীতির অপূর্ব কাহিনী
হযরত দাঊদ নবী (আঃ) চল্লিশ দিন পর্যন্ত সজ্দায় পতিত হইয়া রোদন করিয়াছিলেন। তাঁহার চক্ষুদ্বয় হইতে অবিরাম ধারায় অশ্রু নির্গত হইয়া মৃত্তিকা ভিজাইয়া দিয়াছিল এবং তাহাতে ঘাস অঙ্কুরিত হইয়াছিল। আল্লাহ্ পাকের তরফ হইতে আওয়ায হইলঃ 'হে দাঊদ! রোদন করিতেছ কেন? যদি ক্ষুধার্ত, পিপাসাতুর কিংবা বিবস্ত্র হইয়া থাক, তবে প্রার্থনা কর, এখনই যথেষ্ট আহার্য, পানীয় এবং বস্ত্র প্রদান করা হইবে।' এই সদয় বাণী শ্রবণে তিনি এমন উত্তপ্ত আবেগপূর্ণ রোদন আরম্ভ করিয়া দিলেন যে, তাহার উষ্ণ শ্বাসের উত্তাপে সম্মুখস্থ শুষ্ক কাষ্ঠে অগ্নি ধরিয়া গেল। মহাপ্রভু তাহার তওবা কবুল করিলেন। অতঃপর হযরত দাঊদ নবী (আঃ) প্রার্থনা করিলেন। হে প্রভু! আমার ভুল আমার হাতের তালুর উপর অঙ্কিত করিয়া দাও, আমি যেন উহা ভুলিতে না পারি। আল্লাহ্ তা'আলা তাঁহার প্রার্থনাক্রমে তাঁহার হস্ত-তালুতে ভুল অঙ্কিত করিয়া দিলেন। তিনি যখনই পান-আহার গ্রহণের নিমিত্ত হস্ত বাহির করিতেন তখনই অঙ্কিত পাপ দর্শন করিয়া অঝোরে ক্রন্দন করিতেন। কখন কখন এত অধিক রোদন করিতেন যে, মানুষ তাঁহাকে পান করার জন্য অপূর্ণ পানির পাত্র দান করিত। তিনি পানির পাত্র মুখের কাছে রাখিয়া রোদনই করিতেন, পানি পান করিতেন না। এদিকে অশ্রুজল পতিত হইয়া পাত্রটি পূর্ণ হইয়া যাইত। কথিত আছে যে, রোদন করিতে করিতে তাহার শরীরের বল-শক্তি হ্রাস পাইয়াছিল। তখন তিনি আল্লাহ্ তা'আলার সমীপে নিবেদন করিলেনঃ হে দয়াময়! আমার রোদন দেখিয়া কি তোমার দয়া হয় না?? ওহী আসিল’ ‘হে দাঊদ ! তুমি তোমার রোদনের কথা উল্লেখ করিতেছ, অপরাধের কথা কি ভুলিয়া গিয়াছ?' তিনি নিবেদন করিলেন। 'হে দয়াময়! অপরাধের কথা কেমন করিয়া ভুলিতে পারি? ভুল করিবার পূর্বে যখন আমি যবূর পড়িতাম, তখন আমার আবেগপূর্ণ পাঠ শ্রবণে নদীর স্রোত বন্ধ হইয়া যাইত। বায়ুর প্রবাহ থামিয়া যাইত, আকাশ মার্গে উড্ডীয়মান পক্ষী কুল আমার মাথার উপরে আসিয়া ঝাঁক বাধিত, অরণ্যের জীব-জন্তুরা আসিয়া আমার চতুষ্পার্শ্বে ঘিরিয়া দাঁড়াইত। এখন সে সমস্ত কিছুই নাই। হে প্রভু! সকলেই আমাকে বর্জন করিয়াছে, সকলেই আমায় ঘৃণা করিতেছে। উত্তর আসিল; হে দাউদ! তোমার এবাদতের দরুন তখন সকলে তোমাকে ভালবাসিত। আর এখন ভুলের দরুন সকলে তোমাকে বর্জন করিয়াছে। হে দাঊদ! আদম আমারই দাস। তাহাকে আমি আমার করুণার হস্তে সৃজন করিয়াছি। আমার রূহ আমি তাহার ভিতরে ফুঁকিয়া দিয়াছি। তাহাকে সম্মানিত ও গৌরবান্বিত করার উদ্দেশ্যে তাহাকে সজ্দা করিবার জন্য আমি ফেরেশতাগণকে আদেশ করিয়াছি। শ্রেষ্ঠত্বের পোশাক আমি তাহাকে পরাইয়াছি। সম্মানের মুকুট তাহার মস্তকে স্থাপন করিয়াছি। সে নিজের নির্জনতা ও একাকিত্বের অভিযোগ করিয়াছিল। আমি তাহার চিত্ত বিনোদনার্থে হাওয়াকে সৃজনপূর্বক তাহার নির্জনের সাথী করিয়াছিলাম। কিন্তু সেই আদমকে একটিমাত্র ভুলের জন্য বিবস্ত্র করিয়া অপমানের সহিত আমার দবরার হইতে বাহির করিয়া দিয়াছি। হে দাউদ! তুমি শুন, যথার্থ কর্তব্য মনে করিয়া তুমি আমার এবাদত করিতে অর্থাৎ, ক্রীতদাসরূপে আমার আদেশ-নিষেধ মান্য করিতে, আমিও প্রকারান্তরে তোমার আদেশ পালন করিয়াছি। তোমার যাবতীয় কার্য আমি নির্বাহ করিয়া দিয়াছি। তুমি যাহা চাইতে সব কিছুই আমি তোমাকে দান করিতাম। তুমি ভুল করিয়াছ, আমি তোমাকে অবকাশ দিয়াছি। এখনও যদি তুমি অনুতপ্ত হইয়া কৃত ভুল হইতে তওবা করতঃ আমার দিকে ফিরিয়া আস, তবে আমি তোমার তওবা কবুল করিব, প্রতিশ্রুতি দিতেছি।
ইয়াহইয়া ইবনে আবি কাসীর বলিয়াছেনঃ 'হযরত দাউদ নবী (আঃ) স্বীয় অপরাধের জন্য বিলাপ করিতে ইচ্ছা করিলে রোদনের সাতদিন পূর্ব হইতে আহার ত্যাগ করিতেন এবং স্ত্রী পরিজনের নিকটে গমন করিতেন না। অতঃপর সপ্তম দিবসে রোদন করিবার নিমিত্ত নির্জন অরণ্যে চলিয়া যাইতেন এবং হযরত সুলাইমান (আঃ)-কে বলিতেন: 'আমি আমার ভুলের জন্য রোদন ও অনুতাপ করিতে যাইতেছি, এ কথা জনসমাজে ঘোষণা করিয়া দাও। তিনি তাহা এই বলিয়া ঘোষণা করিয়া দিতেন যে, হে আল্লাহর বান্দাগণ! যাহারা হযরত দাঊদের অনুতাপ-রোদন শ্রবণ করিতে ইচ্ছা কর, অরণ্যের দিকে যাও। এই ঘোষণা শ্রবণে হযরত দাঊদের অনুতাপ রোদন শ্রবণ করিবার জন্য জনপদ হইতে দলে দলে মানুষ, বাসা ছাড়িয়া ঝাঁকে ঝাঁকে পক্ষী অরণ্য ও পর্বতের কন্দর ছাড়িয়া দলে দলে পশু ও হিংস্র-জন্তু হযরত দাঊদের সন্নিকটে আসিয়া পৌঁছিত। হযরত দাঊদ (আঃ) প্রথমে আল্লাহ্ পাকে প্রশংসাগীতি গাহিতেন। শ্রোতৃবৃন্দ সমস্ত জীব-জন্তু আল্লাহ্ পাকের দরবারে আহাজারি করিত, অতঃপর তিনি বেহেশত ও দোযখের অবস্থা বর্ণনা করিতেন। তৎপর নিজের ভুলের জন্য বিলাপ আরম্ভ করিতেন। তাঁহার বিলাপ শ্রবণে বহু শ্রোতা ভয়ে ও মর্ম জ্বালায় প্রাণ ত্যাগ করিত। একদিন তাঁহার বিলাপ শ্রবণের জন্য চল্লিশ সহস্র শ্রোতা একত্রিত হইয়াছিল। তাঁহার অনুতাপ-গীতি শ্রবণে তিন হাজার শ্রোতা মর্ম বেদনায় প্রাণ ত্যাগ করিয়াছিল। অপরাধের ভয়ে হযরত দাঊদের দেহে কম্পন উপস্থিত হইলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি এত জোরে কম্পিত হইত যে, মনে হইত যেন হস্ত-পদ অঙ্গ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িবে। এই ভয়ে তাহার দুই জন দাসী তৎকালে তাহার হস্ত-পদ রক্ষার্থে তাঁহাকে ধরিয়া রাখিত।
👇
হযরত ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)
(কিমিয়ায়ে সা'আদাত)
